আমাদের সময় ছিল অনেকটাই পিটানোর। ছোটবেলার অনেকগুলো ভুলের শাস্তি ছিল শারীরিক। স্কুলে লেট, বেতের বাড়ি। হোমওয়ার্ক না করলে, চড়। টিভি বেশিক্ষণ দেখলে, থাপ্পড়। আমরা ভাবতাম এটাই নরমাল। প্যারেন্টিংয়ের এটা একটা পথ। মা-বাবা না মারলে ছেলেমেয়েরা হয়তোবা মানুষ হয় না।
সেদিক থেকে আজকের বাচ্চারা অনেক বেশি সেনসিটিভ, অনেক বেশি প্রশ্ন করে। একদিন আমার ছয় বছরের মেয়ে জিজ্ঞেস করল, “বাবা, চাঁদে কি সত্যি মানুষ আছে?” আমি যদি শুধু ‘না’ বলে দিতাম, ও আরও দশটা প্রশ্ন করত। তাই আমি ওকে বললাম, “চল, একসাথে খুঁজে দেখি।”
অনেক আগে আমার মেয়ে রিমি (আসল নাম দিচ্ছি না) স্কুল থেকে ফিরে প্রথম যে কথাটা বলল, সেটা আমাকে ভাবিয়ে তুলল। “বাবা, কেন আমার ক্লাসের সবাই আমাকে এড়িয়ে যায়?” আমার প্রথম ইনস্টিংক্ট ছিল বলা – “পড়ালেখায় মন দে, এসব নিয়ে মাথা ঘামাস না।” কিন্তু তারপর মনে পড়ল সেই বইটার কথা – “দ্য আর্ট অফ টকিং উইথ চিলড্রেন”। আমি রিমিকে কাছে ডেকে নিলাম। “চল, আজ তোর স্কুলের গল্প শুনি। কী হয়েছিল বল তো?”
রিমি বলল ও নাকি ক্লাসে একটা ভুল উত্তর দিয়েছিল। সবাই হেসেছিল। তারপর থেকে কেউ ওর সাথে কথা বলে না।
আগে হলে হয়তো বলতাম, “ভালো করে পড়া করবি, এসব হবে না।” কিন্তু আজ বললাম, “জানিস, আমিও তোর বয়সে একবার ক্লাসে দাঁড়িয়ে গোটা পাহাড়কে ‘পাড়’ উচ্চারণ করেছিলাম। সবাই হেসেছিল। কিন্তু পরের দিন আমি আরও ভালো করে পড়ে গিয়ে সবাইকে দেখিয়ে দিয়েছিলাম।”
রিমির চোখে একটা আলো জ্বলে উঠল। “সত্যি বাবা? তুমিও ভুল করেছিলে?”
সেদিন বুঝলাম, আমাদের সময়ের প্যারেন্টিং আর এখনকার প্যারেন্টিং এক নয়। আমাদের বাবা-মা শাসন করতেন, আমাদের বন্ধুত্ব করতে হয়। আমাদের সময় ছিল কিছুটা পিটানোর, এখন আছে প্রশ্ন।
আমার মেয়ে ছোটবেলায় প্রতিদিন স্কুল থেকে ফিরে নতুন নতুন প্রশ্ন করতো। একদিন জিজ্ঞেস করল, “বাবা, মেঘ কি সত্যি তুলোর মতো নরম?” আমি গুগল করে দেখালাম মেঘের ছবি, ভিডিও। তারপর দুজনে মিলে আলাপ করলাম মেঘের উপর দিয়ে কিভাবে উড়া যায়। ম্যাচবক্সের প্লেন বের করে ডেমো দিলাম।
হ্যাঁ, এখনকার বাচ্চারা অনেক বেশি সেন্সিটিভ। তাদের প্রতিটা প্রশ্নের উত্তর লাগে। প্রতিটা আচরণের পেছনে যুক্তি খোঁজে।
তো, রোল্যান্ড যে পাঁচটা জিনিস শিখিয়েছেন:
১. অ্যাক্টিভ লিসেনিং:
রিমি যখন ইউনিভার্সিটির গল্প বলে, আমি আগে মোবাইলে ব্যস্ত থাকতাম। এখন সব কাজ বন্ধ করে শুনি। ওর চোখে চোখ রেখে। দেখি, ও এখন আরও খুলে কথা বলে।
২. ওপেন-এন্ডেড প্রশ্ন:
আগে জিজ্ঞেস করতাম, “ইউনিভার্সিটি কেমন ছিল?” এখন জিজ্ঞেস করি, “আজকে ইউনিভার্সিটিতে কী মজার ঘটনা ঘটল?” দেখি, ও নিজে থেকেই গল্প করে। মাঝেমধ্যে ঝাপটা তো থাকবেই।
৩. ইমোশনাল ভ্যালিডেশন:
ছোটবেলায় রিমির প্রিয় পুতুল ভেঙে গেল। আগে বলতাম, “আরেকটা কিনে দেব, কাঁদিস না।” এখন হলে বলতাম, “হ্যাঁ, প্রিয় জিনিস ভেঙ্গে গেলে কষ্ট লাগে। কিন্তু দেখি, ঠিক করা যায় কি না।”
৪. সেইফ স্পেস তৈরি:
ছোটবেলায় রিমির সাথে প্রতি রাতে আমার সাথে ‘সিক্রেট টাইম’ দেয়া উচিত ছিলো। দশ মিনিট, যেখানে ও যা খুশি বলতে পারে। কোনো বিচার নেই, কোনো শাসন নেই।
৫. স্বাধীনতা ও গাইডেন্স:
ছোটবেলা থেকেই ছোট ছোট সিদ্ধান্ত নিতে দিতাম। কোন ড্রেস পরবে, কোন বই পড়বে – এসব ও নিজেই ঠিক করতো।
এখন বুঝি, বাচ্চাদের সাথে কথা বলা একটা শিল্প। এটা শুধু কমিউনিকেশন নয়, এটা সম্পর্ক তৈরির শিল্প। আর এই শিল্পে পারদর্শী হতে হলে আমাদের নিজেদেরও বদলাতে হবে। কারণ আমরা শুধু বাচ্চা মানুষ করছি না, ভবিষ্যতের মানুষ তৈরি করছি।
লেখক: রকিবুল হাসান; চিফ টেকনোলজি অফিসার (CTO), Link3 টেকনোলজিস।